মৃণালকান্তি দাস : শোনা যায়, জীবনানন্দ একসময় টাকার জন্য কবিতার পাশাপাশি গদ্য লেখা শুরু করেছিলেন। কারণ, কবিতার চেয়ে গদ্য লিখে বেশি টাকা পাওয়া যায়। জীবদ্দশাতে নজরুলের বেশ জনপ্রিয়তা ছিল, তাঁর বইও বিক্রি হত প্রচুর। নজরুলের বই প্রকাশ করে প্রকাশকরা আর্থিকভাবে ফুলে-ফেঁপে উঠলেও নজরুলের সেভাবে কোনও উন্নতি হয়নি। নজরুল রয়্যালটির জন্য প্রকাশকদের দরজায় দরজায় ঘুরেছেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ও প্রাপ্য রয়্যালটি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। শোনা যায়, বাড়িভাড়া বাকি থাকার জন্য বাড়ির মালিক মানিকের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন। লেখালেখি যাদের একমাত্র পেশা বিষয়টা তাঁদের কাছে সত্যিই কষ্টের। এর উল্টো ধারার ইতিহাসও রয়েছে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালী’ তখন ‘বিচিত্রা’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে হঠাৎ একদিন তাঁর বাড়িতে হাজির ‘শনিবারের চিঠি’র সম্পাদক সজনীকান্ত দাস। তিনি বিভূতিভূষণের হাতে কিছু টাকা দিয়ে বললেন, ‘পথের পাঁচালী’ আমি বই আকারে ছাপব! হাতে টাকা পেয়ে বিভূতিভূষণ তো অবাক। সৎ প্রকাশক সেযুগে যেমন ছিল তেমনই এযুগেও আছে, না হলে কিভাবে বই লিখে সেই রয়্যালটির টাকায় একটা আস্ত দ্বীপ কিনতে পারেন বাংলাদেশের জনপ্রিয় লেখক হুমায়ুন আহমেদ।
প্রকাশনার শুরু থেকেই নৈর্ঋতের ভাবনা সেটাই। ছোট-বড়, কোনও লেখকই যেন বঞ্চিত না হন। লক্ষ্য একটাই, ভালো বই ছাপানো। যা সমাজ গঠনে সাহায্য করবে। ‘সত্যি’ ইতিহাসকে মনে করিয়ে দেবে বারবার। যে বই ঘিরে গড়ে উঠবে এক বৈষম্যহীন মানবজাতি। আঁকড়ে ধরবে বিজ্ঞানের পথ চলা। ছোটরা খুঁজে পাবে তাঁদের স্বপ্নের দুনিয়া। নৈর্ঋত প্রকাশনার প্রতিটি কর্মী জানেন সেই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাহিনি। লেখাকেই জীবিকা করে বেঁচে থাকতে চেয়েছিলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। তরুণ শঙ্খ ঘোষ তাঁর নিরাভরণ লেখার ঘর ও সাদামাটা টেবিল দেখে বিস্মিত হওয়াতে মানিক বলেছিলেন: ‘পাঠক যদি বই না কেনে, লাইব্রেরি থেকে বা অন্য কারও কাছ থেকে চেয়েচিন্তে বই পড়ে তাহলে লেখকের ঘর তো এরকমই হবে।’ শেষ জীবনে তাঁর উপলব্ধি ছিল বড় করুণ: ‘চারটে ডালভাতের ব্যবস্থা না রেখে কোনও বাঙালি লেখক যেন লিখতে না আসে।’ এই যন্ত্রণা নয়, শুধু মুনাফা নয়, লেখকের স্বপ্নটাকে বাঁচিয়ে রাখাই নৈর্ঋত প্রকাশনারও স্বপ্ন।
সেটাই হোক প্রকাশনার মূলমন্ত্র…